মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ :
আরব দার্শনিক, সমাজ বিজ্ঞানী ও ইতিদহাসবিদ ইবনে খলদুন পৃথিবীব্যাপী বিখ্যাত ও স্বীকৃত একজন মুসলিম পন্ডিত। ধর্ম বিশ্বাসী মানুষেরাও যে, মুকাদ্দিমার মত অত্যাধুনিক প্রামাণ্য গ্রন্থ রচনা করতে পারেন, ইবনে খলদুন তাঁর অনন্য দৃষ্টান্ত। তিনি যে, এখনো প্রাসঙ্গিক তা অস্বীকার করার অবকাশ নেই। ডেনিয়েল ওলাহ নামক জনৈক বৃটিশ অর্নীতিবিদের প্রখ্যাত সাময়িকী ‘ইকোনোমিক্সে’ প্রকাশিত এক বিশ্লেষণমূলক প্রবন্ধে তাই প্রমাণিত হয়েছে। তাঁর ইতিহাস চর্চা যে, অতি সত্যনিষ্ঠ ছিল তার সত্যতা পাওয়া যায় প্রবন্ধটিতে। ডেনিয়েল ওলানের প্রবন্ধের শিরোনাম হলো; ‘‘বিস্ময়কর আরব পন্ডিত যিনি এ্যাডাম স্মিথকে অর্ধ সহস্র বছর আগেই পরাস্থ করেন”। প্রবন্ধের প্রারম্ভেই লেখক নব্য অর্নীতিবিদগণকে অর্থশাস্ত্রের মিথ্যা ইতিহাস রচনাকারি হিসেবে অভিহিত করেন। আর ইবনে খলদুনের ইতিহাস চর্চাই সত্যনিষ্ঠ ছিল বলে তিনি মন্তব্য করেন। আর ইবনে খলদুন যে, শুধু সমাজ বিজ্ঞানী নন, একজন দার্শনিক ও ইতিহাসবিদ তা আবারও সত্যে পরিণত হলো। এ নিবন্ধে আমরা ইবনে খলদুন-এর জীবন ও অবদান কেন সমসাময়িককালসহ সর্বকালের জন্য প্রাসঙ্গিক তার ওপর একটি পর্যালোচনা তুলে ধরব।
শৈশব ও পড়াশোনা:
ইবনে খলদুন ১৩৩২ সালে ২৭ মে ইয়েমেনী বংশোদ্ভুত আরব পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন ও ১৪০৫ সালের ১৭ মার্চ পরলোক গমন করেন। তিনি ইতিহাসশাস্ত্র রচনা এবং ইতিহাসবিদ হিসেবে খ্যাত। তিনি আধুনিক সমাজ বিজ্ঞান এবং জনসংখ্যা বিজ্ঞানের অন্যতম জনক। তাঁর ‘মুকাদ্দমা’ গ্রন্থটির জন্যই তিনি সবচেয়ে বেশি পরিচিত। তাঁর মুকাদ্দমা গ্রন্থটি এতই গভীর একটি রচনা যে, তাঁর অর্থনীতি, সমাজনীতি, ইতিহাস ও জনসংখ্যা বিষয়ক ভাবনাগুলো অনেক ডাক সাইটে লেখক-ভাবুকরাও বুঝে উঠতে পারেন না। তবে, অনেক গবেষক-চিন্তাবিদ তাতে তাঁদের ভাবনার খোরাক খুঁজে পান। তাঁর গ্রন্থটি পরবর্তীকালের ইতিহাসবিদ, গবেষক, অর্থনীতিবিদগণকে তাঁদের কাজে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছিল। ১৭শ শতাব্দীতে ঐতিহাসিক কাতিব সেলেবী, আহমেদ সেভদেত পাশা এবং মোস্তফা নাইমা; ওসমানিয়া সাম্রাজ্যের অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি হ্রাস পাওয়া এবং শাসনকালের পতন ঘটার কারণ খুঁজতে গিয়ে ইবনে খলদুনের তত্ত্বকে ব্যবহার করেছিলেন। উনবিংশ শতকের ইউরোপীয় পন্ডিতগণ স্বীকার করেন যে, ইবনে খলদুনের বইটি একটি মূল্যবান গ্রন্থ এবং তিনি মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠতম দার্শনিক। তাঁর আত্নজীবনী গ্রন্থে ইবনে খলদুনের জীবন ও কর্ম সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়। তিনি তিউনিসের একটি প্রত্যন্ত গ্রামে আরব বংশোদ্ভুত একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বর্ণনা অনুযায়ি তাঁর পূর্ব পুরুষ ছিলো ইয়েমেনী এবং মহানবী হযরত মুহাম্মদ (দ:)-এর বংশপরম্পরায় তাঁর সাথে আত্নীয়তার সম্পর্কে আবদ্ধ ছিলেন। ১২৪৮ সালে ইবনে খলদুণের পরিবার আন্দুলুসিয়া হতে তিউনিসিয়া গমন করেছিল। তাঁর পরিবারের সদস্যবর্গ গুরত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। কিন্তু ইবনে খলদুনের পিতা এবং তাঁর পিতামহ রাজনীতি হতে দূরে সরে গিয়ে সুফিবাদী জীবন চর্চার দিকে মনোনিবেশ করেছিলেন। তাঁর ভাই ইয়াহিয়া খলদুনও ছিলেন, একজন ইতিহাস লেখক। সরকারি আদালতের ইতিহাস রচনার কাজে নিয়োজিত হওয়ায় ইবনে খলদুনের ভাই ইয়াহিয়াকে প্রতিপক্ষ কতৃক খুন হতে হয়েছিল। তাঁর পরিবার সেকালে শিক্ষা ও রাজনীতি সচেতন ছিল বলে ইবনে খলদুন উঁচু মাপের শিক্ষকদের নিকট পড়াশোনা করার সুযোগ পেয়েছিলেন। শৈশবে তিনি কুরআনে হাফেজ হন। আরবী ভাষা, কুরআন, হাদীস, শরিয়াহ্ এবং ফিক্হাশাস্ত্রে ইবনে খলদুন অত্যন্ত পান্ডিত্যপূর্ণ জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। এসব বিষয়ে কৃতিত্ত্বপূর্ণ ফলাফল করায় ও জ্ঞান-প্রজ্ঞা অর্জনে সক্ষম হওয়ায়, তাঁকে মর্যাদাপূর্ণ সনদপত্র দেয়া হয়েছিল। ধর্মীয় বিষয়ের পাশাপাশি ইবনে খলদুন গণিত, যুক্তিবিদ্যা এবং দর্শনশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। তৎকালিন বিখ্যাত গণিতশাস্ত্রবিদ এবং দার্শনিক টলেমীর নিকট বিখ্যাত সব লেখক, দার্শনিক, ইতিহাসবিদ, বিজ্ঞানীগণের ভাবনা-চিন্তা সম্পর্কে তিনি জ্ঞানার্জন এবং তাদের রচনা অধ্যয়ন করেন। ১৭ বছর বয়সে প্লাগ রোগে আক্রান্ত হয়ে ইবনে খলদুনের মা-বাবা দু‘জনেই মৃত্যুবরণ করেন। পারিবারিক ঐতিহ্যসূত্রে তিনি রাজনৈতিক উচ্চাভিলাস পোষণ করতেন। তাঁর সমসাময়িককালে উত্তর আফ্রিকায় চরম রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করছিল। তাঁর জীবনেও এসময় জেল-জুলুম, গুরুত্বপূর্ণ পদে সমাসীন হওয়া এবং পদ হারানোর মত অনেক ঘটনা ঘটেছে। পরিশেষে, দেশত্যাগও করতে হয়েছে, তাঁকে। ২০ বছর বয়সে ইবনে খলদুন, তিউনিসিয়া সরকারে দলিল-দস্তাবেজ বা সরকারি আইন-কানুন, বিধিমালা, পরিপত্র তৈরি ও জারিকরণ এবং পত্র লিখন ও জারিকরণ সংক্রান্ত বিভাগের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পান। ১৩৫২ সালে তিউনিসিয়া সরকারে পরিবর্তন ঘটে। ২৫ বছর বয়স্ক ইবনে খলদুনকে কারারুদ্ধ করা হয়। তিনি ২২ মাস জেলে কাটান। তৎকালিন শাসক আবু ইনানের মৃত্যু ঘটলে, আল-হাসান ইবনে উমর তাঁকে জেল হতে মুক্তি দেন। পরে তিনি তিউনিসিয়ার মন্ত্রী নিযুক্ত হন। পূনরায় সরকার পরিবর্তন হলে তিনি সরকারি কোন পদ পান নি। অত:পর তিনি একটি কূটনৈতিক দায়িত্ব পান। আরও পরে স্পেনে তিনি নির্বাসিত হন। সেখানেও তিনি কখনো কখনো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। আবার কখনো কখনো দায়িত্ব হারান। তাঁর আত্নজীবনীতে তিনি তাঁর জীবনে ঘটে যাওয়া এসব উত্থান-পতনের কথা লিখেন। তিনি পুণরায় আফ্রিকায় ফিরে গেলে, তৎকালিন তিউনিসীয় সরকার প্রধান আবু আব্দুল্লাহ; ইবনে খলদুনকে তাঁর সরকারের প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। তিনি পুণরায় ক্ষমতা হারান এবং সাধারণ জীবন-যাপন করতে থাকেন। এ সময় তিনি লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটান। অবশেষে ইবনে খলদুন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ আল-মুকাদ্দমা রচনায় হাত দেন। এটা ছিল মূলত: তাঁর বিশ্ব ইতিহাস রচনা শুরু করার পরিবল্পনার প্রথম ধাপ। কিন্তু ইবনে খলদুন হাতের কাছে বিশ্ব ইতিহাস রচনার জন্য পর্যাপ্ তথ্য ও দলিল-প্রমাণাদি পাচ্ছিলেন না। ফলে, তিনি ১৩৭৮ পূনরায় তিউনিসিয়ায় ফিরে যান। তিনি এ সময় সরকারি কাজে পুণরায় দায়িত্ব পান। ইবনে খলদুন তাঁর গবেষণা কাজ ও অন্যান্য লেখালেখির কাজে পূর্ণরূপে মনোনিবেশ করেন। আর তাঁর বিশ্ব ইতিহাস রচনার কাজটি এসময় সম্পন্ন করেন। শাসকগোষ্ঠী তাঁকে নিয়ে আবার বিতর্ক শুরু করে। ইবনে খলদুন হজ্বব্রত পালনের কথা বলে মক্কা শরীফ যাওয়া কথা বলে তিউনিসিয়া ত্যাগ করেন। তিনি মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া গিয়ে পৌঁছেন। তিনি সেখানে পৌঁছেও ক্ষমতা-বলয়ের বাইরে থাকতে পারেন নি, বেশি দিন। ১৩৮৪ সালে মিশরের সুলতান তাঁকে কামহিয়া মাদ্রাসার অধ্যাপক পদে নিয়োগ করেন এবং সরকারি বিচারক নিযুক্ত করেন। তিনি মূলত: ইমাম মালেকের অনুসারিগণের বিচারক বা কাজী ছিলেন। পশ্চিম আফ্রিকায় ইমাম মালেকের অনুসারিগণের সংখ্যাধিক্য ছিল। তাঁর ভাবনা-চিন্তা বা ইসলামী মতামতসমূহ সার্বজনীনতা না পাওয়ায়, তিনি বিচারক পদ হতে সরে দাঁড়ান। আর তাঁর পদত্যাগের অন্যতম কারন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, ব্যাক্তিগত একটি দুর্ঘটনা। ১৩৮৪ সালে এক জাহাজ দুর্ঘটনায় ত্তাঁর স্ত্রী ও সন্তানরা মৃত্যুবরণ করে। ইবনে খলদুন তখন হজ্বব্রত পালনের লক্যে এ মক্কা শরীফ গমনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সেখান হতে ফিরে এসে ইবনে খলদুন ১৩৮৮ সালে, মিশরের কায়রোস্থ মাদ্রাসাগুলোতে ইসলামী ও আধুনিক শিক্ষা সংস্কারের কাজে পূর্ণ মনোনিবেশ করেন। এসময় শাসক গোষ্ঠীর সঙ্গে তাঁর কিছু সময়ের জন্য মত বিরোধ চলে। পরে তিনি আবার ইমাম মালেক (রহ:)-এর অনুসারিগণের বিচারক নিযুক্ত হন। শেষবারে এ বিচারক নিযুক্তি পাওয়াসহ ইবনে থলদুন ৬ বার সরকারি উচ্চ পর্যায়ে দায়িত্ব পান, কিন্তু কখনো তা দীর্ঘ সময়ের জন্য ছিল না। ১৪০১ সালে তিনি তৎকালিন মিশরের শাসক ফারাজের পক্ষ হয়ে মঙ্গোলীয় বীর ও দেশ বিজেতা তৈমুরের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে যোগদান করেন। তৈমুর তখন সিরিয়ার রাজধানী দামাসকাস দখল করেছিলেন। অভিযানে অংশ নিলেও তিনি মিশরের শাসক ফারাজের শক্তি-সামর্থ্যের ওপর ভরসা রাখতে পারছিলেন না। ফারাজ অন্তর্দ্বন্দ্বে পড়ে তৈমুরের নিকট পরাজিত হন। সেইসাথে ইবনে খলদুনও সাত সপ্তাহ ধরে শহরে অবরুদ্ধ থাকেন। আর তৈমুর সরকার ও ফারাজ বাহিনীর মধ্যকার দূতিয়া্লীর কাজে লিপ্ত হন ইবনে খলদুন। এসময় তৈমুর তাঁর সাথে অনেকবার বৈঠকে মিলিত হন এবং ইবনে খলদুনকে সামগ্রিক পরিস্থিতির ওপর একটি বিসম্তারিত প্রতিবেদন দাখিল করতে দায়িত্ব অর্পন করেন, তৈমুর। মঙ্গোলীয় রাজ্য বিজেতা তৈমুর ইবনে খলদুনের নিকট অনেক কিছু জানার চেষ্টা করেন। এসময় তিনি ৫ বছর ধরে আত্নজীবনী ও বিশ্ব ইতিহাস রচনার কাজ সমাপ্ত করেন। আর ‘রিজাল’ নামে একটি গোপন রাজনৈতিক দল গঠন করে ইবনে খলদুন ব্যাপক জন সমর্থন লাভ করেন। শাসক গোষ্ঠী বৃদ্ধ ইবনে খলদুনকে কারারুদ্ধ করে। ১৪০৬ সালে ১৭ মার্চ, তিনি পরলোক গমন করেন।
ইবনে খলদুন কী এখনো প্রাসঙ্গিক?
বর্তমান নিবন্ধের শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, ডেনিয়েল ওলাহ নামক একজন স্কলার বিখ্যাত বৃটিশ ‘ইকোনোমিক্স’ সাময়িকীতে ইবনে খলদুনকে বাজার অর্থনীতির জনক খ্যাত আধুনিক অর্থনীতিবিদ এ্যাডাম স্মিথ-এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ অর্থনীতি বোদ্ধা হিসেবে অভিহিত করেছেন। ডেনিয়েল লিখেন যে, জোসেফ স্কাম্বাপ্টার ১৯৫৪ সালে তাঁর ‘হিস্টোরি অব ইকোনোমিক এ্যানালিসিস’ গ্রন্থে বুঝাতে চেয়েছেন অর্থনীতির ইতিহাস রচনায় বড় ধরণের গলদ রয়ে গেছে। প্রাক-খ্রিষ্টীয় এবং বুদ্ধিবৃত্তীয় অর্থনীতির তত্ত্ব রচানায় অর্থনীতিকে বিষয় হিসেবে দাঁড় করাতে গিয়ে সাধারণ কিছু ভুল ধারণার নিরসন করা হয় নি। আর মধ্যযুগে ইবনে খলদুনের অর্থনীতির রচনার ধারাটিকে এড়িয়ে চলার কারণে তা হয়েছে। আর এসময় অর্থনীতির তাত্ত্বিক ভিত্তি হিসেবে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে বাণিজ্যিক ধারা বা স্কটল্যান্ডেীয় এন্লাইটেন্টমেন্টিক ভাবনা-চিন্তাকে। আসলে অর্খনীতি ভাবনার সূচনা কিন্তু সেখান থেকে উৎসারিত হয় নি। ১৪শ শতাব্দীতে অর্থনীতি নিয়ে ইবনে খলদুনই সর্বপ্রথম পদ্ধতিগত বিচার-বিশ্লেষণ শুরু করেন। তিনি তাঁর পূর্ববতী স্কলারগণের অর্থনীতি ভাবনাকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করে প্রথম বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি অর্থনীতিতে প্রতিফলন ঘটান।(ফনসেকা,১৯৮৮)। ইবনে খলদুনের আগে ইসলামী ইতিহাসবিদগণের রচনাবলী ছিল অপরিপক্ক, সম্পাদনাহীন অথবা সনাতনী ধারা অনুসরেণে। তাঁরা গতানুগতিক ধারায় তাঁদের কাজগুলো করেছিলেন। ইবনে খলদুন অভিমত দেন যে, তাঁদের এসব বিচার-বিশ্লেষণকে নাকচ করে দিয়ে সত্যতা যাচাই করে এবং ভূয়া ঐতিহাসিক তথ্যাদি বাদ দিয়ে নতুন এক দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে অর্থনীতিসহ বিশ্ব ইতিহাস রচনা করতে হবে। আর এ জন্য প্রয়োজন ইতিহাসবিদদের কাল্পনিক গল্পরাজি পরিহার করে মানব সামাজিক সংগঠন অনুসন্ধান এবং সঠিক মাপকাঠি প্রয়োগ করে তা করতে হবে। এটা সম্পূর্ণ একটি নতুন, মৌলিক এবং স্বতন্ত্র বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি, যা পূর্বে কখনো ছিল না। বর্তমান আধুনিক ও নতুন অর্থনীতির তাত্ত্বিক বিচার-বিশ্লেষণের যুগে এসে ইবনে খলদুনের ভাবনাগুলোর উদ্ধৃতি অনেকের কাছে বিব্রতদকর মনে হতে পারে। তিনি পর্যবেক্ষণ করেন যে, শ্রম বিভাজন যে কোন সভ্য সমাজের জন্য ভিত্তি হিসেবে কাজ করে এবং তিনি চিহ্নিত করেন শ্রম বিভাজন শুধু শিশল্পকারখানা স্তরের হবে না, তা বরং সামাজিক এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়েও হবে। ইবনে খলদুন দৃষ্টান্ত দেন যে, খাদ্য-শস্য আহরণের ক্ষেত্রে শ্রম বিভাজন উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টি করে। এভাবে কেহ নিজের জন্য এবং অন্যদের জন্য অনেকের মধ্য হতে সঞ্চিত ক্ষমতার সম্মিলন না ঘটিয়ে, তা করতে পারবেন না। সহযোগিতার মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের চাহিদা অনেক বেশি মেটানো যাবে, তাদের নিজেদের দ্বারা সংগৃহিত জিনিষের চেয়ে। এখান হতেই অর্থনীতিতে এ্যাডাম স্মিথের বহুল প্রচলিত ‘চাহিদা ও সরবরাহ’-এর তত্ত্বগত ধারণা ইবনে খলদুন দিয়ে যান। আসলে ১৯০০ শতাব্দীতে নয় ১৪০০ শতাব্দীতে বাজার অর্থনীতি তত্ত্ব ইবনে খলদুন উদ্ভাবন করেছিলেন। ইবনে খলদুনের গতিশীল অর্থনৈতিক তত্ত্বে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ্ ভূমিকার কথা আছে। এ নীতিতে করারোপ যে প্রাথমিকভাবে সভ্যতার বিকাশে বিরাট প্রভাবক হিসেবে কাজ করে তা উল্লেখ করা হয়েছে। যাযাবরদের জীবন-যাপনে রূপান্তর হয়ে নগর সভ্যতার বিকাশ ঘটিয়েছে। যাযাবরীয় অর্থনীতি হতে সভ্য জগতে উত্তীর্ণ হওয়ার মধ্যবর্তী সময়কাল দলগত মূল সংহতির অবসান ঘটিয়ে নতুন মক্কেল বা গ্রহক প্রবণতার জন্ম দিয়েছিল। নতুন দল গঠন প্রবণতা নতুন সেনা বাহিনীর সৃষ্টি করে। তাই নগর সভ্যতা গভীরতা লাভ করার ফলে বিলাসী রাজ শা্সনের বিকাশ ঘটিয়েছে। আর শাসকরা বৃদ্ধি করে করারোপ প্রবণতা। ফলে, বর্ধিত হারে করারোপ প্রবণতা অর্থনীতিতে ধস নামায়। ইবনে থলদুন বিশ্লেষন করে দেখান যে, রাজশাসন প্রথার শুরুতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ ব্যবসায় ও পণ্যের ওপর করারোপ বেশি বেশি করা হত। অর্থাৎ মাইক্রো অর্থনীতিতে প্রাথমিকভাবে এর চাপ আরোপিত হয়েছিল। পক্ষান্তরে তিনি ব্যবসায় বাণিজ্যে শুল্ক আরোপ এবং সরকারি হস্তক্ষেপকে প্রত্যাখ্যান করেন, কারণ সরকারে আর্থ-রাজনৈতিক ক্ষমতা অনানুপাতিক হারে অনেক ব্যাপক। মধ্যযুগে ইবনে খলদুনের এসব ধারণার প্রকাশকে নব্য অর্থনীতি তাত্ত্বিকগণ কোন মতেই নাকচ করতে পারছেন না। তাই তাঁরাও খলদুনের উদ্ধৃতি দেন এখন। কিন্সীয় অর্থশাস্ত্র ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ প্রবণতায়ও ইবনে খলদুনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণকে অস্বিাকার করা হয় না। ইবনে খলদুনের বিশ্লষণ; “রাজশাসন এবং সরকার বিশ্বের ব্যাপক বাজারকে প্রভাবিত করে, আর তা সভ্যতার উপাদান হয়ে যায়। বর্তমানে সরকার যদি সম্পদ ও রাজস্ব নিয়ন্ত্রণ করে, অথবা তারা লোকসান দেয়, তার যথাযথ ব্যবহারে ব্যর্থ্ হয়ে যায়, তখন সরকারের সম্পদের পরিমাণ হয়ে যায় ক্ষুদ্র। এভাবে তারা যখন ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করতে যায়, ব্যবসায় গতি কমে যায় এবং সম্পদের স্বল্পতা হেতু বাণিজ্যিক ভারসাম্য বিনষ্ট হয়। অধিকন্তু, শাসক ও প্রজাদের মাঝে অর্থ ঘুরপাক খেতে থাকে। তখন যদি শাসকরা তা ধরে রাখতে যায়, প্রজারা মার খায়। ১৪০০ শতাব্দীতে উত্তর আফ্রিকায় ইবনে খলদুন অর্থনীতিকে এভাবে বিশ্লেষণ করে যান।
ইবনে খলদুনের রচনাবলি:
ইবনে খলদুনের মূল কাজ হলো; ‘কিতাব-আল-ইবর’ নামক গ্রন্থ রচনা। এর বাংলা অর্থ দাঁড়ায় ‘শিক্ষণীয় বিষয়াবলির বই।’ কিতাব-আল-ইবর গ্রন্থটি ৭ খন্ডে বিভক্ত। প্রথম খন্ডটি আল-মুকাদ্দমা বা পটভূমি। দ্বিতীয় ও পঞ্চম খন্ডের নাম ‘মানুষের ইতিহাস’। তৃতীয়, চতৃর্থ, ষষ্ট ও সপ্তম খন্ডে বর্বরদের মানূষ এবং পশ্চিমাদের ইতিহাস লেখা হয়েছে। ইবনে থলদুনের এ গ্রন্থটির অনেক দিক নিয়ে সমালোচনা আছে। কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাস রচনায় এটাকে অমূল্য দলিল হিসেবে সবাই স্বীকার করেন। বিশেষত: র্ববরদের নিয়ে তিনি যে সব তথ্য পরিবেশন করেছেন তা দুর্বল বলে অভিহিত করা হয়। কিন্তু সমাজ বিজ্ঞান বিশ্লেষণ করার ক্ষেত্রে ইবনে খলদুনের অবদানকে সবাই প্রামাণ্য বলে মানেন। বাংলা ভাষায় তাঁর গ্রন্থটি বাংলা একাডেমী খন্ডে খন্ডে প্রকাশ করেছে। আর অনুবাদ করেছেন; প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক গোলাম সামদানী কোরায়শী। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত পন্ডিত অধ্যাপক ড. মঈন উদ্দিন আহমদ খান, ইবনে খলদুনের আল-মুকাদ্দমা গ্রন্থে আলোচিত জ্ঞান বিষয়টি বিশ্লেষণ করে ছোট্ট একটি অসাধারণ পুস্তক রচনা করেন। এ ছোট্ট গ্রন্থটিতে ‘জ্ঞান’ শব্দটিকে ড. খান যেভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন, তাকে অমূল্য সম্পদ বলা যায়।
উপসংহার: মুসলামানের ঘরে মধ্য যুগে ইবনে সিনা, ইবনে খলদুন, আল-কেমী, আল-জাবের, ইবনে হাইয়ান, ইবনে রুশদ, ইমাম গাজ্জালীর মত জগত জুড়ে খ্যাতি অর্জনকারি জ্ঞান-বিজ্ঞান, সমাজ বিজ্ঞান, ইতিহাস, দর্শন প্রভৃতি ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন এমন সব প্রতিভার জন্ম হয়েছিল। মুক্ত বুদ্ধির চর্চা ইসলামী সভ্যতাই এ পৃথিবীতে সর্বপ্রথম শুরু করেছিল। বলা যায়, জ্ঞান জগতের সকল ক্ষেত্রে মুসলমানরাই বিচরণের সূচনা ঘটিয়েছিল। আর বর্তমান সভ্যতায় এখন পশ্চিমাদের জয় জয়কার। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মুসলমানের সংখ্যা অতি নগন্য। অথচ ৫৪ টি মুসলিম দেশে সহায়-সম্পদ মোটেই কম নয়। কিন্তু দূ:খের বিষয় এসব মুসলিম দেশের একটিতেও বিশ্বমানের একটি বিশ্ববিদ্যালয় খুঁজে পাওয়া যা্য় না। সেই মধ্যযুগে ইবনে খলদুন যদি কুরআনে হাফেজ ও ইসলামী জ্ঞান অর্জন হতে অত্যাধুনিক সব জ্ঞান অর্জন করে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন এবং গ্রন্থ রচনা করে যেতে পারেন, এ যুগে সব কিছু হাতের মুঠোয় পেয়েও মুসলমানরা কী করছে, তা ভেবে দেখার সময় এসছে; বৈ কি!
*সহকারি উপজেলা শিক্ষা অফিসার, মহেশখালী, কক্সবাজার।